ঈমানদার যুবক আর যাদুকরের রাজত্ব: গুহার ছেলেদের বিস্ময়কর ইতিহাস

 

ঈমানদার যুবক আর যাদুকরের রাজত্ব: গুহার ছেলেদের ইতিহাস



রাত গভীর। রাজপ্রাসাদের ভেতর আলোর ঝলকানি, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে অন্ধকার।
এক রাজা, যিনি দাবি করেন—তিনিই সৃষ্টিকর্তা। এক রাজত্ব, যেখানে সত্য উচ্চারণ ছিল অপরাধ। সেখানে একজন যুবক, নাম তার ইতিহাসে নেই—কিন্তু তার ঈমান, তার ধৈর্য, তার কোরবানি আজও আলো হয়ে জ্বলছে মুসলিম হৃদয়ে।

এই গল্পটি এসেছে সহীহ মুসলিম থেকে। হাদীস নম্বর: ৩০০৫, “আশাবুল উখদুদ” তথা খন্দকের সাহাবিদের প্রসঙ্গে। এই কাহিনির কিছু অংশ পবিত্র কুরআনেও রয়েছে, সূরা আল-বুরুজ-এ (৮৫:৪-৮)।


👑 এক নিষ্ঠুর রাজা ও এক যাদুকরের গল্প

এক দেশে এক রাজা ছিল। সে ছিল ভয়ানক যালিম। সে নিজেকে রাব (প্রভু) বলে দাবি করত। তার দরবারে ছিল এক বিখ্যাত যাদুকর, যার সাহায্যে সে মানুষকে তার শাসনের অধীনে রাখত।

কিন্তু একদিন যাদুকর বার্ধক্যে পৌঁছে গেল। সে রাজার কাছে গিয়ে বলল, “রাজা, আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমাকে একজন বুদ্ধিমান ছেলে দিন, যাকে আমি আমার জাদু শিক্ষা দিয়ে যেতে পারি।” রাজা খুঁজে খুঁজে একজন বালককে পছন্দ করল এবং পাঠাল যাদুকরের কাছে।


🧕 পথে দেখা সেই রহস্যময় সাধু

প্রতিদিন সেই ছেলে যাদুকরের কাছে যেত শিক্ষা নিতে। কিন্তু একদিন সে রাস্তায় এক “রাহিব” বা এক ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গে দেখা করে। রাহিব তাকে তাওহীদের কথা শেখায়, আল্লাহর ভয়, জান্নাত-জাহান্নামের কথা বলে।
ছেলেটি ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে—এই রাজা তো আল্লাহ নয়। আসল প্রভু তো একজনই—যিনি আকাশ, বাতাস, মানুষ, মৃত্যু ও জীবন সবকিছুর মালিক।


⚡ যুবকের ঈমান ও অলৌকিক ক্ষমতা

একদিন সে রাজাকে নয়, বরং আল্লাহর পথে নিজেকে সমর্পণ করল।
আল্লাহ তাকে বিশেষ ক্ষমতা দিলেন। সে অন্ধকে চক্ষু দিত, কুষ্ঠ রোগ সারাত, এমনকি মরণাপন্ন রোগীদের দোয়ার মাধ্যমে ভালো করত—এইসবই আল্লাহর ইচ্ছায়।
রাজ্যের মানুষ একে একে তার মাধ্যমে শিফা পেতে লাগল। এমনকি এক রাজ-অন্ধও তাকে খুঁজে এসে সুস্থ হয়ে গেল।


👑 রাজার ক্রোধ ও ঈমানের পরীক্ষা

রাজার কাছে খবর পৌঁছাল। রাজার নির্দেশে যুবককে ধরে আনা হলো। রাজা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি এখন এমন ক্ষমতা পেয়েছো যে মানুষকে ভালো করতে পারো?”
যুবক বলল, “আমি কিছুই করি না। আমার রব, আল্লাহর ইচ্ছায় সব হয়।”
রাজা চিৎকার করে উঠল, “তাহলে তুমি আমাকে প্রভু মান না?!”
যুবক বলল, “তুমি কোনো প্রভু নও। আমার প্রভু একমাত্র আল্লাহ।”
তখন রাজা যুবককে নির্যাতন শুরু করল। যুবকের সাথি রাহিব ও রাজ-অন্ধকেও ঈমান ত্যাগে বাধ্য করল। কেউ কেউ শহীদ হল, কেউ নির্যাতনের মুখে।


🎯 যুবককে হত্যা করার ৩টি ব্যর্থ চেষ্টা

রাজা যুবককে তিনবার হত্যা করতে চাইল।

  1. প্রথমবার: পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু আল্লাহ পাহাড় কাঁপিয়ে দিলেন, সেনারা মারা গেল, যুবক ফিরে এল।
  2. দ্বিতীয়বার: মাঝনদীতে ফেলে দেওয়া হলো। নৌকা উল্টে গেল, সবাই মারা গেল, যুবক তীরে এসে পৌঁছাল।
  3. তৃতীয়বার: এবার যুবক নিজেই বলল, “যদি তুমি আমাকে মারতে চাও, তাহলে জনসমক্ষে একটি কাঠের বেদিতে আমাকে বেঁধে দাও এবং বলো—'এই যুবক আল্লাহর নামে বলছে', তারপর তীর চালাও। তাহলে আমি মরব।”

রাজা তাই করল।

তিনি বললেন, “বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম—এই যুবকের রবের নামে!

তীর ছোঁড়া হলো—যুবক মারা গেল।


🌊 কিন্তু রাজা হেরে গেল…

যুবক মারা গেল ঠিকই, কিন্তু সেই বাক্য—"এই যুবকের রবের নামে"—সেই বাক্যই রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল।

পুরো রাজ্যে মানুষ বলতে লাগল, “আমরাও সেই আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি।”

রাজা প্রচণ্ড রেগে গেল। সে একটি বড় খন্দক (গর্ত) খনন করাল, তাতে আগুন জ্বালাল। তারপর বলল—“যে আমার ধর্ম ত্যাগ করবে না, তাকেই এই আগুনে ফেলে দাও।”

পুরো রাজ্যজুড়ে আগুন জ্বলল, কিন্তু হাজারো মানুষ তবুও ঈমান ধরে রাখল।


👶 এক শিশু যিনি কথা বললেন…

এক নারী, যিনি একটি ছোট শিশুকে বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আগুনের মুখে। তার পা কাঁপছে। ঠিক তখনই সেই নবজাতক শিশু মুখ খুলে বলল,

“হে মা, ধৈর্য ধর। তুমি সত্য পথে আছো।”

তখন মা আগুনে লাফ দিলেন, এবং শহীদ হলেন। এই ঘটনা কুরআনের সূরা আল-বুরুজে উল্লেখ করা হয়েছে—

📖 “তারা সেই মুমিনদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল, কেবল এজন্য যে তারা ঈমান এনেছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর।”
— (সূরা আল-বুরুজ: ৮৫:৮)


🌟 শিক্ষা: এক যুবকের ঈমান বদলে দিল এক রাজ্যকে

এই গল্পের শেষে আমরা শিখি—

  • একজন যুবকের ঈমান ও দাওয়াহ কিভাবে রাজশক্তিকে কাঁপিয়ে দেয়
  • মৃত্যুভয় নয়, আল্লাহর সন্তুষ্টি বড়
  • যারা দাওয়াহ ও সত্যের পথে থাকে, তাদের জীবন হয় শহীদের মর্যাদায়
  • সত্য উচ্চারণের জন্য একটি প্রজন্মই যথেষ্ট


আজ আমাদের চারপাশে অনেক “যাদুকরের রাজত্ব” আছে—অবিশ্বাস, গুনাহ, চক্রান্ত, ইসলাম থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা। প্রশ্ন হলো—আমরা কি সেই যুবকের মতো সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারব?

তাঁর নাম ইতিহাস মনে রাখেনি। কিন্তু তাঁর ঈমান ইতিহাস বদলে দিয়েছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন